ঢাকা,সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ায় ইয়াবা কারবারের সহযোগী না হওয়ায় গার্মেন্টকর্মীকে উলঙ্গ করে পেটানোর ভিডিও ফেসবুকে ছড়াল আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল!

‘ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি করায় এলাকার লোকজন তাকে ডাক্তার সোহেল হিসেবেই ডাকে এবং চেনে’

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া (কক্সবাজার) ঃ

কক্সবাজারের চকরিয়ায় ইয়াবা কারবারের সহযোগি না হওয়ায় এক গার্মেন্টকর্মীকে উলঙ্গ করে অমানুষিকভাবে শারিরিক নির্যাতনের সময় ধারণ করা ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। অভিযুক্তের নাম মোহাম্মদ সোহেল ওরফে ডাক্তার সোহেল। সে উপজেলার কোনাখালী ইউনিয়নে দুই নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পশ্চিম নতুন ঘোনার মৃত আবদুল হকের ছেলে। ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি করায় এলাকার লোকজন তাকে ডাক্তার সোহেল হিসেবেই ডাকে এবং চেনে।

অভিযোগে জানা গেছে, কোনাখালী ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সোহেলের সঙ্গে খালাতো বোন আয়েশা আক্তার নামের এক নারীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এই অবস্থায় ওই নারী সোহেলের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি গোপন রেখে পেকুয়ার উজানটিয়া ইউনিয়নের নূরীরপাড়ার মো. আরিফ নামের অপর এক গার্মেন্টকর্মীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে।

এই সম্পর্কের আড়াই মাস না যেতেই ওই নারী আরিফকে প্রস্তাব দেয় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে। এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান গার্মেন্টকর্মী আরিফ। কিন্তু ওই নারী আগের প্রেমিক খালাতো ভাই আওয়ামী লীগ নেতা সোহেলকে অসৎ উদ্দেশ্যে বিষয়টি জানান। এর পর সোহেল ঢাকায় অবস্থানকালে ফোন করে গার্মেন্টকর্মী আরিফকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে একটি হোটেলকক্ষে আটকে রেখে উলঙ্গ করে শারিরিকভাবে অমানুষিক নির্যাতন চালান। উলঙ্গ অবস্থায় গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ভিডিও ধারণ করেন। এ সময় আরিফের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা, সঙ্গে থাকা মোবাইলসহ সবকিছু। এ সময় জোরপূর্বক ননজুডিসিয়াল স্টাম্পে স্বাক্ষর নেওয়াসহ ভবিষ্যতে আয়েশার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ করবে না মর্মে মুচলেকাও আদায় করেন সোহেল। সেই মোতাবেক নির্যাতন সহ্য করেও ওই নারীর সাথে আর যোগাযোগ রাখেননি গার্মেন্টকর্মী আরিফ।

কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল নিজের ধারণকৃত সেই উলঙ্গ ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে প্রতিনিয়ত টাকা আদায় করতে থাকেন আরিফের কাছ থেকে। আরিফও নিজের সম্মানের দিকে চেয়ে প্রতিনিয়ত টাকা দিয়ে আসছিল সোহেলকে।

ভুক্তভোগী আরিফ অভিযোগ করেছেন, গত জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে সোহেল ফোন করেন তাকে। এ সময় সোহেল গার্মেন্টকর্মী আরিফকে প্রস্তাব দেন, তার সাথে ব্যবসা করতে। কীসের ব্যবসা জানতে চাইলে সোহেল বলেন, ‘প্রতিমাসে দশ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে। বিপরীতে ঢাকা, গাজীপুর, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইয়াবার চালান নিয়ে যেতে হবে।’

আরিফ বলেন, ‘সোহেলের এই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায়, প্রায় তিনবছর আগে ধারণকৃত আমার উলঙ্গ ভিডিওচিত্র ইংরেজিতে ‘টাইমস অব চকরিয়া নিউজ’ নামের একটি ফেসবুক আইডিতে সম্প্রতি শেয়ার করেন। অমানুষিক নির্যাতনের এই ভিডিওটি মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এনিয়ে নিন্দার ঝড় উঠে চকরিয়া-পেকুয়াজুড়ে।’

ভুক্তভোগী আরিফ বলেন, ‘উলঙ্গ অবস্থায় অমানুষিক নির্যাতন চালানোর ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ায় আমি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরাও করতে পারছি না। আমার মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল। এনিয়ে প্রথমে চকরিয়া থানায় গেলেও ঘটনাস্থল চকরিয়ায় না হওয়ায় অভিযোগ দিতে পারিনি। এর পর এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ পেকুয়া থানায় দিয়ে আসি। সেই অভিযোগটি পেকুয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) কাজী আবুল বাশার তদন্ত করছেন। কিন্তু ইয়াবা ব্যবসার গডফাদার সোহেল প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকায় আমার অভিযোগটির কোন অগ্রগতি নেই। একই অভিযোগ নিয়ে দ্বারস্থ হই কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মহোদয়ের। এই অবস্থায় আমি নিজের জীবন খোয়ানোর শঙ্কার ভয়ে চট্টগ্রামে চলে এসেছি, যোগ দিয়েছি গার্মেন্টসে নিজের কাজে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোনাখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সচেতন বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী অভিযোগ করেছেন, কয়েক বছর আগেও আওয়ামী লীগ নেতা সোহেলের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সে অঢেল সম্পদের মালিক। তার চলাফেরায় ফিরেছে আভিজাত্যও। এলাকায় সে ইয়াবার গডফাদার হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত। তার কারণে এলাকায় আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে যুবসমাজ। তার বিরুদ্ধে আইনগত এবং দলীয় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।

কোনাখালী ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ন আহবায়ক আমিনুল হক আমিন চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল এলাকায় একজন বড় ধরণের ইয়াবা কারবারি। বৈধপথে তার কোন আয়ের উৎস নেই। চিকিৎসা পেশার সাথে সম্পৃক্ত না হলেও ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি করায় এলাকার লোকজন তাকে ডাক্তার সোহেল হিসেবেই ডাকে এবং চেনে।’

এ বিষয়ে পেকুয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) কাজী আবুল বাশারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি এখনকার ঘটনা নয়। তবে অভিযোগটি পাওয়ার পর গভীরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে।’

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ সোহেল চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হচ্ছে তার কোনটাই সত্য নয়। তাছাড়া যে ভিডিওচিত্র ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, সেখানে আমি নেই।’

অবশ্য ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর কোহেলিয়া টিভি নামের কথিত একটি অনলাইন মাধ্যমে অভিযুক্ত সোহেল দাবি করেছিলেন, তার খালাতো বোন আয়েশাকে অপহরণের জের ধরে গার্মেন্টকর্মী আরিফকে সে উলঙ্গ করে পিটিয়েছিলেন। পেকুয়ার সংবাদকর্মীদেরও একই তথ্য দিয়েছিলেন সোহেল।

পাঠকের মতামত: